জীবের শ্রেণীবিন্যাস হলো একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর সকল জীবকে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে কতগুলো দল উপদলে বিন্যস্ত করা হয়। এই পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য জীব। এদের প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা করে জানা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু প্রতিটি জীব সম্পর্কে জানার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জীবের শ্রেণীবিন্যাসের ফলে এদের সম্পর্কে জানা অনেকটা সহজ হয়েছে।
জীবের শ্রেণীবিন্যাস এর সংজ্ঞা: যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পৃথিবীর সকল জীবকে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন দল ও উপদলে বিন্যস্ত করা হয় তাকে শ্রেণীবিন্যাস বলে। দ্বিপদী নামকরণ থেকে পর্যায়ক্রমে আধুনিক শ্রেণীবিন্যাস উন্নতি লাভ করেছে। সুয়েডীয় প্রাণিবিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ক্যারোলাস লিনিয়াসকে হচ্ছে আধুনিক শ্রেণীবিন্যাসের জনক। তিনি সর্বপ্রথম আধুনিক দ্বিপদী নামকরণের ধারণা দেন।
জীবের শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা
শ্রেনী বিন্যাসের ফলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অল্প সময়ের মধ্যে কম পরিশ্রমে জীবজগৎ তথা উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা যায়। নতুন প্রজাতির জীব শনাক্তকরণ ও বৈজ্ঞানিক নামকরণে জীবের শ্রেণীবিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এককথায় জীবের শ্রেণীবিন্যাসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
জীবজগৎ
ক্যারোলাস লিনিয়াসের সময়কালে জীবজগৎকে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণী জগৎ এই দুই রাজ্যে শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছিল। এই ধারনা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদ্যামান ছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এইচ হুইটেকার জীবের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য উপাত্ত, জীবদেহে কোষের সংখ্যা, কোষের বৈশিষ্ট্য, DNA ও RNA এর প্রকারভেদ, এগুলোর উপর ভিত্তি করে জীবজগৎকে ৫ টি রাজ্যে ভাগ করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
হুইটেকারের এই শ্রেণীবিন্যাসকে ১৯৭৪ সালে মারগুলিস পরিবর্তিত করে বিস্তারিত রূপ দেয়। তিনি সমস্ত জীবকে দুটি সুপার কিংডমে বিভক্ত করে পাঁচটি রাজ্যকে এই দুই সুপার কিংডমের অন্তর্ভুক্ত করেন।
সুপার কিংডম-১
প্রোক্যারিওটা: এরা এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব এবং কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে না।
রাজ্য-১ মনেরা:
বৈশিষ্ট্য সমূহ-
- এরা এককোষী জীব।
- একটি কোষের সাথে আরেকটি কোষ লম্বালম্বি যুক্ত হতে ফিলামেন্ট তৈরি করে, তাই এরা ফিলামেন্টাস।
- কলোনিয়াল
- এদের কোষে ক্রোমাটিন বস্তু রয়েছে। তবে নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়ার মেমব্রেন থাকে না।
- কোষে রাইবোজোম আছে কিন্তু প্লাসটিড, মাইটোকন্ড্রিয়া ইত্যাদি থাকে না।
- শোষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য গ্রহণ করে। তবে এই রাজ্যের কিছু জীব সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে।
- এরা দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে।
যেমন: ব্যাকটেরিয়া, নীলাভ সবুজ শৈবাল ইত্যাদি।
সুপার কিংডম-২
ইউক্যারিওটা: এরা এককোষী অথবা বহুকোষী হতে পারে। কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে, এককভাবে অথবা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে।
রাজ্য-২ প্রোটিস্টা:
বৈশিষ্ট্য সমূহ-
- এরা এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে।
- এককভাবে, দলবদ্ধভাবে অথবা ফিলামেন্ট তৈরি করে বসবাস করে।
- কোষ সুগঠিত নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট, কোষে নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ক্রোমাটিন বস্তুকে ঘিরে রাখে।
- ক্রোমাটিন বস্তুতে RNA, DNA ও প্রোটিন থাকে।
- শোষণ অথবা ফটোসিনথেটিক পদ্ধতিতে খাদ্য গ্রহণ করে।
- মাইটোসিস কোষ বিভাজন পদ্ধতিতে অযৌন প্রজনন ঘটায়।
- কনজুগেশনের মাধ্যমে যৌন প্রজনন ঘটায়, প্রজননের পর কোন ভ্রূণ সৃষ্টি হয় না।
যেমন: এককোষী এবং বহুকোষী শৈবাল, অ্যামিবা ইত্যাদি।
রাজ্য- ৩ ফানজাই:
বৈশিষ্ট্য সমূহ -
- এককোষী অথবা দেহ সরু সুতার মতো মাইসেলিয়াম দিয়ে গঠিত।
- এদের বেশিরভাগ স্থলজ, পরজীবী বা মৃতজীবী।
- কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস বিদ্যমান।
- শোষণ পদ্ধতিতে খাদ্য গ্রহণ করে।
- কোষ প্রাচীর বা সেল মেমব্রেন কাইটিন নামক বস্তু দিয়ে গঠিত।
- ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না।
- হ্যাপ্লয়েড স্পোরের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে।
যেমন: পেনিসিলিয়াম, মাশরুম ইত্যাদি।
রাজ্য -৪ প্লান্টি:
বৈশিষ্ট্য সমূহ-
- দেহে উন্নত টিস্যু তন্ত্র রয়েছে।
- কোষে প্রকৃত নিউক্লিয়াস থাকে। এরা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত করে।
- অধিকাংশ স্থলজ তবে অনেক জলজ প্রাণীও রয়েছে।
- এরা অ্যানাইসোগ্যামাস যৌন প্রজনন অর্থাৎ পুরুষ ও স্ত্রী গ্যামেট এর মাধ্যমে যৌন প্রজনন ঘটায়।
- সপুষ্পক এবং ভ্রূণ সৃষ্টির পর থেকে ডিপ্লয়েড পর্যায় শুরু হয়।
যেমন: সবুজ উদ্ভিদ।
প্লান্টি রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিচে ছক আকারে দেখানো হয়েছে।
রাজ্য -৫ অ্যানিমেলিয়া:
বৈশিষ্ট্য সমূহ-
- এরা বহুকোষী প্রানী ও কোষে নিউক্লিয়াস উপস্থিত।
- কোষে জড় কোষপ্রাচীর নেই, প্লাস্টিড ও কোষগহ্বর থাকে না।
- এরা নিজের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে না। তাই এরা হেটেরোট্রোফিক অর্থাৎ পরভোজী এবং খাবার গলাধঃকরণ করে।
- দেহে জটিল টিস্যু তন্ত্র রয়েছে।
- অ্যানিমেলিয়া রাজ্যের বেশিরভাগ জীব যৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। পুরুষ গ্যামেট বা শুক্রাণু ও স্ত্রী গ্যামেট বা ডিম্বাণুর মিলনে জাইগোট তৈরি হয়।
- যেমন: সকল মেরুদন্ডী ও অমেরুদন্ডী প্রানী (প্রোটোজোয়া ব্যাতীত)।